আ.স.ম. জাকারিয়া:: শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মে দিবস একটি আপোষহীন সংগ্রাম দীপ্ত দিন। পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় শিকাগোর রাজপথ। ধনতান্ত্রিক শাসন কাঠামোতে শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করে মালিকরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। রুটি রুজির তাগিদে শ্রমিককে অত্যাচার বঞ্চনা সহ্য করে ও উদায়াস্ত মালিকের কারখানায় কাজ করতে হতো। এ শ্রমের পরিমাণ ছিল দৈনিক আঠারো ঘন্টা থেকে বিশ ঘন্টা। এ অমানুষিক অত্যাচার ও শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমেরিকার শ্রমিকরা প্রথম আন্দোলন করে।
এ আন্দোলনের দাবি ছিল বিশ ঘন্টা কাজের সীমাকে দশ ঘন্টায় নামিয়ে আনা। ১৮০৬ সালে কল কারখানায় দৈনিক কর্ম প্রহর ছিল বিশ ঘন্টা। অবশেষে শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে ৮ ঘন্টার কর্মঘন্টা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের শ্রমজীবীরা ৮ ঘন্টা দৈনিক কাজ করে। জীবনের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং বেঁচে থাকার জন্য নুন্যতম মজুরী তারা সেদিন আদায় করে নিয়েছিল।
তাদের সেই দেখানো পথ ধরেই বিশ্বের শ্রমজীবীরা লড়াই, সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অধিকার আদায়ের। আজকে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের শ্রমিকরা অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে, তা সেই ১ মের অনুপ্রেরণা। মে দিবস বিশ্বের সমস্ত শ্রমিকদের সংগ্রাম, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের প্রতিক। মে দিবস মালিকের শোষণ- বঞ্চনা অত্যাচার উৎপীড়ন এর বিরুদ্ধে সংঘবন্ধ প্রতিবাদ।
ধনতান্ত্রিক শোষণের যাঁতা কলে দুনিয়ার মেহনতিরা আজও পিষ্ট। শ্রেণি- বৈষম্যের দাসত্বের শৃংখল ভেঙ্গে শোষিত মানুষ আজো মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত। ন্যায অধিকার চাইতে গেলে জীবন দিতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে , গুম, হত্যা, জেল, জুলুম সহজাত ঘটনা।
আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে যে দাবী গুলোর জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজ-পথ রঞ্জিত করেছিল, এতো বছর পরেও সে দাবী আদায় করতে রক্ত ঝরে, জীবন যায়।
নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, ন্যার্য মুজুরী, সংগঠন করার অধিকার এ দাবী গুলো জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের বাস্তবায়তায়, শ্রমিকরা তার কতটুকু পাচ্ছে, তা একটু পর্যালোচনা করা দরকার।
বর্তমান বাংলাদেশের সকল শিল্প সেক্টরে কর্মঘন্টা অনির্দিষ্ট। নুন্যতম দশ ঘন্টা থেকে বারো ঘন্টা দৈনিক কর্মঘন্টা। এর বাইরেও ওভার টাইম কথিত কাজ করানো হয়। যা মূলত কর্মঘন্টাই। কারণ ওভার টাইম বলতে যা বুঝায়, অর্থাৎ অতিরিক্ত বেতন ভাতা যা দ্বিগুন, তা কিন্তু দেয়া হয় না। সুতরাং এটাও কর্মঘন্টার শামিল।
এ ব্যাপারে কোন মহলের কোন সাড়া শব্দ নাই। মালিকরা তাদের উৎপাদনের দোহাই, রপ্তানী সহ বিভিন্ন দোহাই দিয়ে এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখছে। সরকার তাদের সহযোগিতায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। শ্রমিক নেতা ও শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকা প্রশ্নবোধক।
সাপ্তাহিক ছুটি, উৎসব ছুটি গুলো খুব কমই পায়। বেশ কিছু শিল্প কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি মিলে না। বিভিন্ন অযুহাতে এগুলো পাওয়া হয় না। সাপ্তাহিক ছুটি অন্যান্য উৎসব ছুটি স্ব-বেতনে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইন ও আছে, কিন্তু বাস্তুবে নাই।
ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার যা আইন সিদ্ধ। শ্রম আইনে ধারা ১৭৬। আই. এল ও কনভেনশন ৮৭। মানবাধিকারে ২৩ (ঘ) ধারা। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ৩৮ এ সংগঠিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের শিল্প কারখানায় বিশেষত, গার্মেন্টস সহ নব গঠিত সকল শ্রেণির শিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন নাই। এমন কি করার মত বাস্তবতাও নাই। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার পক্ষে নয়।
শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পৃথক আইন, নিয়ম, বিধি রয়েছে। তাদের জন্য আলাদা আদালত রয়েছে, তাদের সংগঠন করার জন্য নিয়মনীতির মাধ্যমে রেজি: করতে হয়। তাদের জন্য আলাদা পুলিশ বাহিনী আছে অথচ অন্য কোন শ্রেণির সংগঠন করার জন্য রেজি: সহ অন্য নিয়ম কানুন নাই।
শ্রমিক সংগঠনগুলো তার আসল কাজটা করে না। সুবিধাবাদী চিন্তায় সংগঠন তরে। বিভিন্ন এন.জি ও কর্তৃক সুবিধা নেয় আর তাদের কথামত, তাদের দেয়া নিয়ম অনুযায়ী সংগঠন পরিচালনা করে। ভাবতে অবাক লাগে, কোন সংগঠনই শ্রমিকদের চাকুরী হারালে, চাকুরী ফিরে পাওয়ার দেন-দরবার আন্দোলন সংগ্রাম করে না। ট্রেড ইউনিয়ন রেজি: না পেলে করণীয় নির্ধারণ করে না। এনজিও গুলো কৌশলে তাদের স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে, কিছু সুবিধাবাদী সংগঠনের ছত্রছায়ায়।
সংগঠন গুলো, চাকুরী হারাদের, অধিকার বঞ্চিতদের এবং ট্রেড ইউনিয়ন রেজি: বঞ্চিতদের শ্রম আদালতে পাঠায়। যা মালিকরা ও চায়। তারপর শুরু হয় খেলার খেলা। শ্রম আদালতের তারিখের পর তারিখ। দিশেহারা ভূক্তভোগি, এক সময় পালিয়ে বাঁচে । এদিকে সংগঠনের সুবিধাবাদী চক্র মালিকের সাথে আঁতাত করে ফায়দা লুটে।
বর্তমানে সুন্দর একটি সিস্টেম চালু হয়েছে কোন কিছু ঘটলে, প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন। পেপার, পত্রিকা বিবৃতি, তাও আবার টাকা লাগে। কিছু ধামা ধরা লোক দিয়ে লোক দেখানে মানববন্ধন। এ টুকুই আন্দোলন সংগ্রাম। শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা জন্য কত আইন, নিয়ম কানুন। আইন অনুযায়ী কারখানা চালাতে হবে। নিরাপদ কর্মক্ষেত্রে থাকতে হবে। না মানিলে এ ব্যবস্থা সে ব্যবস্থা। সরকারি সংস্থা গুলোর দায়িত্ব, পরিদর্শন করে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা।
বাস্তবতা আমরা কী দেখতে পাই। যদি কোন কারখানায় কোন দূর্ঘটনা ঘটে তখন যে সকল তথ্য আমরা পাই, শুনি, রীতিমত এক নৈরাজ্য কর অবস্থার মধ্য দিয়ে এদেশের শিল্পকারখানার স্থাপনা গুলো গড়ে উঠেছে। নিরাপত্তার বালাই নাই, বিল্ডিং কোড মানা হয় না। কারখানার মেশিন পত্র নিয়ম মাপিক স্থাপন করা হয়নি। অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সিঁড়ি গুলো সরু এবং অপর্যাপ্ত। স্বাস্থ্য বিধি মানা হয় না। বয়লার গুলো পুরানো, কোন রকম সংস্কার করা হয়নি ইত্যাদি।
আর যখন দুর্ঘটনা ঘটলো, শুরু হলো অযুহাত। লোক বল কম। এক শ্রেণির শ্রমিক দরদী নেতা, ক্ষতিপূরণ নিয়ে ব্যস্ত । অন্য কোন বিষয় তাদের মাথা ব্যথা নাই। মানববন্ধন করে, বিবৃতি দেয় যথাযথ ক্ষতিপূরণের জন্য। বাকী সব ফাঁকি এখানে তাদের কিছু স্বার্থ থাকলেও থাকতে পারে। আজ পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ নাই যে, অনিয়ম দূর্নীতি, শ্রমিক হত্যার জন্য কোন মালিকের বিচার হয়েছে।
আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে যে শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি লড়াই সংগ্রাম করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সে অধিকার গুলো আইনের বেড়ি পরিয়ে ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে। ডিজিটাল করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে সমস্ত কিছু মালিকদের লাভের অংকে।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করার আন্দোলন জোরদার করা উচিত। আইনের সংশোধন করে প্রতিটি শিল্পকারখানায় সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম অপরিহার্য। এ অধিকারটা প্রতিষ্ঠার পরই অন্য অধিকার অনায়াসে পাওয়ার আন্দোলন করা যাবে।
বর্তমানে কর্মঘন্টা অনির্দিষ্ট। সংগঠনের অধিকার বলতে নাই। শিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নাই। সরকারের এক চোখা নীতি আছে। সুতরাং আগামী দিন গুলো অন্ধকারময়। আলোয় আসতে হলে, সংগঠিত শক্তি নিয়ে সংগঠন করার অধিকার, কর্মঘন্টা এবং শোভন কাজের নিশ্চয়তার জন্য দুর্বার আন্দোলন অপরিহার্য। লেখক: শিক্ষক, শ্রমিক নেতা ও সাংস্কৃতিককর্মী।