মো: মুর্শিকুল আলম, গাজীপুর :: ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশের সবচেয়ে কর্কশ ঋতু গ্রীষ্মকাল। মূলত বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস নিয়ে গ্রীষ্মকাল হলেও গরমের আগমনটা ফাল্গুনের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়। আর তা বহমান থাকে জ্যৈষ্ঠের পরেও। গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে প্রকৃতি থাকে উত্তপ্ত। ফলে এই সময়টা দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কোথাও স্বল্প পরিসরে আবার কোথাও ভয়াবহ। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার সবকয়টিই ঘটেছে শহরাঞ্চলে। এসব অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতি যেমনই হোক না কেন কিন্তু আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক হিমসিম খেতে হচ্ছে। অগ্নিকান্ডেবা ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী নিহত ও আহত হয়েছে।
পবিত্র ঈদ উল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দোকানগুলো সাজিয়েছিলেন। কিন্তু এসব অগ্নিকান্ডে তাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শহরাঞ্চলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতি বেশি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই অসচেতন জনগণকে জানাতে হলে আগে আমাদের মনে রাখতে হবে অগ্নিকাণ্ডের উপকরণ, কারণ ও এই ব্যাপারে কী কী সাবধানতা আমাদের নেওয়ার প্রয়োজন। সবার আগে বুঝতে হবে অগ্নিকাণ্ডের জন্য কী কী উপাদান কাজ করে। পড়ালেখা করাতে যেমন বই, খাতা, কলমের প্রয়োজন, একটি সংবাদ লিখতে হলে যেমন অসংখ্য তথ্যের প্রয়োজন তেমনি অগ্নিকাণ্ডও এমনিতে ঘটে না। যদি সেটা জানতে পারি, তাহলে সাবধান হতে সুবিধা হয়। অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম উপকরণ হলো অত্যধিক তাপ, জ্বালানী ও অক্সিজেন। চলুন জেনে নেই এগুলো কিভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে সাহায্য করে। আগুন অথবা অত্যধিক তাপ হতে পারে সেটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে। আগুন যদি নাও থাকে, অত্যধিক তাপ থেকেও কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ধরন ও প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তাড়াহুড়ো করেই হোক আর খরচ বাচাতে গিয়েই হোক নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে। পোষাক শিল্পে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বিশেষত যে কারণটি লক্ষ্য করা যেতে পারে তা হলো কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক কর্মচারি ধুমপান করে। যখন বিরতি দেয়া হয় তখন অনেকেই এখানে সেখানে দাড়িয়ে ধুমপান করে। এরপর যখন ঘণ্টা বা সাইরেন বাজে কাজে ফিরে যাওয়ার তখন অনেকেই হাতের সিগারেট বা বিড়ির অবশিষ্টাংশটুকু যত্রতত্র ফেলে দেয়। সেই রেখে যাওয়া সিগারেটের অল্প একটু আগুন ভেতরের তাপে আরো বেশি উত্তপ্ত হয় এবং একসময় ভয়াবহ আগুন হিসেবে সব জ্বালিয়ে দেয়। মশার কয়েল থেকেও অগ্নিকাণ্ডের সুত্রপাত হতে পারে।
আর ঘটমান এই অগ্নিকাণ্ডগুলো ভয়াবহ হবার কারণ বিশ্লেষণে উঠে আসে যে, শপিংমল কিংবা কারখানা গুলোতে অগ্নি নিবার্পক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে না। কোন এক ফ্লোরে আগুন লাগলে সাথে সাথে যদি অটো অ্যালার্মিং সিস্টেম চালু থাকে তবে অন্য ফ্লোরে অবস্থানরতরা আগেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অন্তিম মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারে আগুন লেগেছে। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। আর বিল্ডিং তৈরির আইনটি তৈরি হয়েছে ২০০৬ সালে। ফলে অনেক ভবন আগে তৈরি দুঘর্টনার সময় হতাহতের পরিমান বাড়ে। গলদ রয়েছে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও। এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
যান্ত্রিক এই কারণগুলো ছাড়াও অন্যতম কারণ হলো সাধারণ জনতার নিরক্ষরতা ও আগুনের বিষয়ে শিক্ষার অভাব। আমেরিকায় সাধারণ জনতাকেও আগুনের ব্যাপারে শিক্ষিত করা হয়। স্কুল-কলেজে শেখানো তো হয়ই, কর্মক্ষেত্রেও নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা আছে বলে আমি জানি না। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা নাই। ফলে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করার সময় বা সুযোগ পাই। পূর্বেই বলেছিলাম আগুন শুধু আর্থিক ক্ষতি করে না একটি স্বপ্নকেও কেড়ে নেয়। তাই কোথাও কোন অবস্থাতেই আগুন লাগুক এটা কারো কাম্য হতে পারেনা। সচেতনতাই পারে এর থেকে আমাদের রক্ষা করতে। তবে এই সচেতনতার জন্য তাহলে আমাদের করণীয় কী তাও কিন্তু জানতে ও জানাতে হবে। উচিত আগুন যেন না লাগে, সেটা খেয়াল রাখা। অফিস আদালতে আগুন নিয়ে কাজ কারবার না করাই ভালো।
ঘরের ভেতরে ম্যাচের কাঠি, সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি অ্যালাউ না করা। চুলা জ্বালানো কাজে ওসব লাগলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। বাড়ির বাইরেও জ্বলন্ত সিগারেট, জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি যেখানে সেখানে ছুড়ে না ফেলা। বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট ইত্যাদি নিয়মিত চেক করা। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বৈদ্যুতিক আগুনে পানি ঢালা চলবে না। এতে আগুন ভয়াবহ রূপ নেবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে মেইন সুইচ অফ করে দিতে হবে। তারপরে ফোম বা বালি ছিটাতে হবে। কিন্তু পানি না। দাহ্য পদার্থ বাড়িতে না রাখা। রাখলেও সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে যেখানে আগুন লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে, সেখানে অবশ্যই এসব পদার্থ না রাখা। প্রতিটা কমার্শিয়াল দালানে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট রাখা, যদি না থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা করা। যদি তার পরও কেউ ব্যবস্থা করতে না চান, তাহলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করা। ফায়ার এক্সিট না থাকলে কোনো কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণের অনুমতি না দেওয়া।
আসলে আইন বা নিয়ম না-মানার কারণেই আমাদের দেশে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে একটার সঙ্গে আরেকটার গা ঘেঁষে৷ কোনো নিয়মের তোয়াক্কা ছাড়াই গড়ে উঠেছে ভবন। এক্ষেত্রে অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায়-দায়িত্বও তাঁদের ওপর বর্তায়৷ এমনকি যেসব কর্তৃপক্ষের এইসব আইন কার্যকর করার কথা, তারাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। যে ক্ষেত্রে আগুন নেভানো, মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং জরুরি উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা দরকার, সেসব ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই আসুন সকলে আগুনের নিরাপদ ব্যবহার করি ও সচেতন থাকি। নিজেকে নিরাপদ রাখি।